গাজা যুদ্ধের প্রথম ছয় সপ্তাহের মিডিয়া কভারেজ সম্পর্কে কন্টেন্ট অ্যানালাইসিস বা বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট এবং লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের কভারেজ পক্ষপাতদুষ্ট ছিল এবং তা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গেছে।সপ্তাহান্তে যখন খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, বাইডেন ইসরাইলে ৮০০ কোটি ডলারের অস্ত্র সরবরাহের বিল অনুমোদন করেছেন তখন একজন মার্কিন কর্মকর্তা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, 'আমরা ইসরাইলকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা গড়ে তোলার কাজ অব্যাহত রাখব।' গাজায় গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে বলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পক্ষ থেকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বাইডেনের সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করা হয়। এ কারণে বাইডেনের এই সিদ্ধান্ত একটি নতুন নৈতিক অবক্ষয় হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। পার্সটুডের তথ্য অনুসারে, নরম্যান সলোমন 'গণহত্যাকারী প্রেসিডেন্ট, গণহত্যা নীতি' শীর্ষক একটি নিবন্ধে লিখেছেন- একজন ব্যক্তি হিসেবে বাইডেনের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যুক্তিসঙ্গত।
ইসরাইলে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র পাঠানো অব্যাহত রাখার বিষয়ে তার সিদ্ধান্তগুলো মারাত্মক বিপর্যয়কর। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এই নীতি এবং মার্কিন কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের এই প্রক্রিয়ায় সেদেশের গণমাধ্যমও যুক্ত হয়েছে। গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার চল্লিশ দিন পর অ্যান বয়ার ঘোষণা করেন যে, তিনি টাইমস ম্যাগাজিনের কবিতা সম্পাদকের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।এক বছরেরও বেশি সময় পরে তার বক্তব্যটি বহু লিবারেল প্রতিষ্ঠানের নৈতিকতার পতনকেই তুলে ধরছে। অ্যান বয়ার গাজার জনগণের বিরুদ্ধে মার্কিন-সমর্থিত যুদ্ধের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, আমি এমন কবিতা নিয়ে কাজ করতে পারি না যা গাজায় অন্যায়ের পক্ষে কথা বলে।দ্য ইন্টারসেপ্ট এর মাধ্যমে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট এবং লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস নামের তিনটি পত্রিকা সংবাদ ও তথ্য পরিবেশন করতে গিয়ে ইসরাইলিদের মৃত্যুকে বড় করে তুলে ধরেছে এবং ইসরাইলিদের মৃত্যুর ঘট্না অনেক বেশি আবেগপূর্ণ ভাষায় বর্ণনা করেছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনিদের মাধ্যমে নিহত ইসরাইলিদের কথা বলতে গিয়ে 'গণহত্যা' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ব্যাপকভাবে। এই অনুপাতটা ১২৫ ইসটু ২। অর্থাৎ ইসরাইলি নিহত হওয়ার ক্ষেত্রে গণহত্যা শব্দটি ১২৫ বার ব্যবহার করা হলে ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র দুই বার। একই ভাবে 'ভয়াবহ' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ৩৬ ইসটু ৪ অনুপাতে। এর মানে হলো যখন একজন ইসরাইলি নিহত হত, তখন সেটাকে একজন ফিলিস্তিনি মহিলা এবং শিশু নিহত হওয়ার চেয়ে ৯ গুণ বেশি ভয়াবহ বলে তারা বিবেচনা করেছে।
গাজা যুদ্ধের এক বছর পর আরব-আমেরিকান ইতিহাসবিদ রশিদ খালিদী বলেছেন, “নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে আমি অভিযোগ হলো তারা সবকিছুকে ইসরাইলি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। তারা এটা দেখে যে, ইসরাইলিরা কীভাবে প্রভাবিত হয়, ইসরাইলিরা এটাকে কীভাবে দেখে। ইসরাইল তাদের বিশ্বদৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। গাজা থেকে সরাসরি রিপোর্টিং না করে ইসরাইলিরা চালাকির সাথে ইসরাইল-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও শক্তিশালী করেছে।খালিদি আরও বলেছেন, “মূলধারার গণমাধ্যমগুলো অন্ধ রয়ে গেছে, যেমনটি তারা এর আগেও ছিল, এখনও তারা প্রতিটি বর্বর মিথ্যাচারকে সত্য বলে চালিয়ে দিচ্ছে। ক্ষমতাদের কথায় ওঠবস করছে। ওয়াশিংটন থেকে যা বলা হচ্ছে তাই পুনরাবৃত্তি করছে।”
মার্কিন মিডিয়া গাজার শিশুদের কথা যেন ভুলেই গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ ইসরাইলি অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করা হয়েছে। সেই অস্ত্র ও গোলাবারুদে গাজায় নিহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। নিহতদের মধ্যে অর্ধেকই শিশু। কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য মার্কিন মিডিয়া বাইডেনকে জবাবদিহি করেনি।২০২২ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ইউভালডে শহরের স্কুলে বন্দুক হামলা হয়। হামলায় ১৯ শিক্ষার্থী ও ২ শিক্ষক নিহত হন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে জনতার উদ্দেশে জো বাইডেন বলেছিলেন, "এমন কিছু বাবা-মা আছেন যারা তাদের সন্তানকে আর কখনও দেখতে পাবেন না।" তিনি আরও বলেন: “একজন সন্তান হারানো মানে আত্মার একটা অংশ হারিয়ে ফেলা।" এটি এমন একটি অনুভূতি যা ভাইবোন, দাদা-দাদি, নানা-নানি, পরিবারের অন্য সব সদস্য এবং সমাজও অনুভব করে। কিন্তু কেন আমরা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে বাঁচতে ইচ্ছুক? আমরা কেন এটা করেই চলেছি?"
কিন্তু এই জো বাইডেনের সরবরাহকৃত অস্ত্র ও গোলা-বারুদ দিয়েই ফিলিস্তিনে প্রতিদিন বহু শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে।আমেরিকার টেক্সাসের উভালদে গণহত্যায় ১৯ জন শিশুর প্রাণহানি ঘটে। গাজায় প্রতিদিনের গণহত্যায় কয়েক ঘন্টার মধ্যে এই সংখ্যক ফিলিস্তিনি শিশুর প্রাণহানি ঘটেছে এবং ঘটছে। শুধু মার্কিন প্রেসিডেন্ট নন, সেদেশের জাতীয় সংসদও গাজা গণহত্যায় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সিনেটর চাক শুমার এবং প্রতিনিধি হাকিম জেফ্রিসের মতো নেতারাও কার্যত উল্লেখযোগ্য কিছুই করেননি।গাজা যুদ্ধের প্রথম কয়েক মাসে মিডিয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক খবর প্রচার হলেও ক্রমেই তা কমে এসেছে; ইসরাইলের মাধ্যমে চলমান হত্যাকাণ্ডকে স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে।
গাজা ইস্যুতে আমেরিকার মূল ধারার গণমাধ্যম ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে খবর প্রকাশ করলেও কিছু সাংবাদিক বিবেকের তাড়নায় প্রতিবাদমুখর হয়েছিলেন। কিন্তু তাদেরকে কাজ করতে দেওয়া হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভাইস নিউজে’র সাংবাদিক লামা আরিয়ানের একটি কমেন্ট থেকে পরিস্থিতি আঁচ করা যায়। তিনি লিখেছেন- ‘আমি আমার অনেক পশ্চিমা সহকর্মীর কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে শুনেছি যে গাজার মানবিক সঙ্কট সম্পর্কে টুইট করলেও তাদের চাকরি চলে যেতে পারে, তাই তারা নীরব রয়েছেন।’ বিখ্যাত সাময়িকী ইলাইফের প্রধান সম্পাদক মাইকেল আইজেন থেকে শুরু করে নিউ ইয়র্ক টাইমসের ফটো সাংবাদিক হোসাম সালামকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করার দায়ে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে।
পশ্চিমা মিডিয়ার সম্পাদকেরা একজন ইসরাইলি নিহত হলে যেভাবে তার নাম, বয়স ও ইতিহাস নিয়ে লিখতে শুরু করেন সেভাবে কখনোই ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে লেখেন না, তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের গল্পগুলো তুলে ধরেন না। এসবের ধারাবাহিকতায় পশ্চিমা সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো মুখরোচক শিরোনামকে অনুমোদন দেয়। সেগুলো অনেকটা এমন- গাজায় ইসরাইলের বৃহত্তম সামরিক অভিযান চলছে। সেই ইসরাইলি অভিযানের বর্বরতা তাদের কাছে কখনোই গুরুত্ব পায় না। মিডিয়া কভারেজ নিয়ে বহু গবেষণায় বার বার তা প্রমাণিত হয়েছে।